লাঠমার হোলি, বারসানা গ্রাম (উত্তর প্রদেশ)
উত্তর প্রদেশের মথুরা থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বারসানা গ্রাম। এখানকার হোলি উদযাপিত হয় দারুণ উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সঙ্গে। বারসানা গ্রামটি দেশের সুপরিচিত তীর্থস্থানগুলির মধ্যে অন্যতম। পুরাণ অনুসারে এটি রাধার জন্মস্থান। এই গ্রামের হোলি ‘লাঠমার হোলি’ নামে পরিচিত। শুধুমাত্র রং দিয়েই নয়, এখানে হোলি খেলা হয় লাঠি দিয়েও। পুরাণ কাহিনি অনুসারে, হোলির দিন এই গ্রামে গিয়ে কৃষ্ণ রাধা এবং তাঁর সখীদের উত্যক্ত করতেন। গ্রামের মহিলারা এই ব্যাপারটি ভালোভাবে মেনে নেননি। তারা কৃষ্ণকে লাঠি হাতে তাড়া করেন। সেই থেকে প্রথা আজও চালু আছে যে, হোলির সময় মহিলারা লাঠি দিয়ে পুরুষদের তাড়া করেন এবং লাঠির আঘাত করেন। মার খাওয়ার জন্য পুরুষরাও প্রস্তুত থাকেন। আসলে এটি বর্তমানে প্রতীকী অনুষ্ঠান। প্রিয় নারীর হাতে লাঠির আঘাত খাওয়ার জন্য এইদিন পুরুষরা মুখিয়ে থাকেন। এই অনুষ্ঠান দেখতে কাতারে কাতারে মানুষ এখানে ভিড় জমান।
হোল্লা মহল্লা, পঞ্জাব

হোলির দিন পঞ্জাবের নিহঙ্গ শিখরা পালন করেন হোল্লা মহল্লা অনুষ্ঠান। দশম শিখ গুরু, গুরু গোবিন্দ সিং এই পরবের সূচনা করেন। উদ্দেশ্য ছিল শরীরচর্চার দক্ষতা বিকাশ। এই হোল্লা মহল্লা যোদ্ধাদের হোলি নামেও পরিচিত। এই দিন কুস্তি, মার্শাল আর্ট, তরোয়াল খেলা সহ নানা শক্তি প্রদর্শনী খেলায় অংশ নেন নিহঙ্গ শিখরা। সাহস এবং শক্তি প্রদর্শনের এই কৌশলগুলি দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। এসব ছাড়াও এদিন অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ সহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন শিখরা। তারপর হয় রঙের পরব হোলি উদযাপন।
রং পঞ্চমী, মহারাষ্ট্র

মহারাষ্ট্রের হোলিকে বলা হয় ‘রং পঞ্চমী’। রং খেলা ছাড়াও এদিন মহারাষ্টের পালিত হয় আরেক অনুষ্ঠান। শুক্লা পঞ্চমীর শেষ দিন সূর্যাস্তের পর হোলিকা দাহ হয়। খড় দিয়ে হোলিকার পুতুল গড়ে তাতে আগুন ধরানো হয়। অনেকটা আমাদের বুড়ির ঘর পোড়ানোর মতো। হোলিকা দাহর অর্থ, মন্দের উপর ভালোর জয়লাভ। হোলিকা দহনের পরের দিন অর্থাৎ পালিত হয় রং পঞ্চমী। একে অপরের গায়ে রং, আবির মাখিয়ে আনন্দ করেন সবাই। হোলির দিন মহারাষ্ট্রের ঘরে ঘরে তৈরি হয় ‘পুরান পোলি’। যার স্বাদ অসাধারণ।
শিগমো, গোয়া

গোয়ার হোলি আবার একটু অন্যরকম। এর পোশাকী নাম শিগমো। শিগমো হল গোয়াবাসীদের বসন্ত উৎসব। বসন্ত ঋতু উদযাপনের মাধ্যমে রাস্তার মধ্যেই ঐতিহ্যবাহী লোক নৃত্য এবং পথ নৃত্যের আয়োজন করেন তাঁরা। এই সময় আঞ্চলিক এবং আধ্যাত্মিক সাজে নিজেদের নৌকা সাজান মৎস্যজীবীরা শিগমো উদযাপনের দুটি রূপ, ধাকতো শিগমো এবং ভাদলো শিগমো। যার অর্থ ছোট এবং বড়। গ্রামের মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণি এবং কৃষকরা পালন করেন ধাকতো শিগমো। আর ভাদলো শিগমো উদযাপন করেন সমস্ত উচ্চ-মধ্য-নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা নির্বিশেষে।
মঞ্জুল কুলি, কেরল

উত্তর ভারতে যতটা উদ্দীপনার সঙ্গে হোলি উদযাপিত হয়, দক্ষিণা ভারতে ততটা হয় না। তবে সেখানেও উৎসাহ নেহাত মন্দ নয়। এখানে কিছু সম্প্রদায়ের মানুষ এই রঙের উৎসবে মেতে ওঠেন। যেমন কেরল। কেরলের হোলি ‘মঞ্জুল কুলি’ নামে পরিচিত। এটি উদযাপিত হয় গোসরিপুরম থিরুমার কোঙ্কনি মন্দিরে। প্রথম দিনে ভক্তরা মন্দির পরিদর্শন করেন। দ্বিতীয় দিনে, তাঁরা একে অপরের গায়ে রঙিন জল ছিটিয়ে দেন। জলে মেশানো থাকে হলুদ। এদিন ঐতিহ্যবাহী লোকগীতি এবং নৃত্যে মেতে ওঠেন সকলে।
ইয়োসাং, মণিপুর

মণিপুরে হোলিকে বলা হয় ইয়োসাং বা ইয়াওল শাং। এই রঙিন উৎসব পালিত হয় পাঁচ দিন ধরে। মণিপুরের দেবতা ‘পাখংবা’কে শ্রদ্ধা জানাতেই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ইয়োসাঙের প্রথম দিন সূর্যাস্তের পর পালন করা হয় কুঁড়ে ঘর পোড়ানোর অনুষ্ঠান। এর নাম, ‘ইয়াওসাং মে থাবা।’ এরপর পালিত হয় ‘নাকাথেং’ নামে এক ঐতিহ্যবাহী রীতি। এই রীতি মেনে ছোটোরা বাড়ি বাড়ি চাঁদা তুলতে যায়। দ্বিতীয় দিনে মন্দিরে সংগীত পরিবেশন করা হয়৷ দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিনে মহিলারা দান সংগ্রহ করেন। এবং শেষ দুই দিন লোকেরা একে অপরের গায়ে জল এবং রং ছিটিয়ে পালন করে ইয়োসাং উৎসব।
দোল যাত্রা, পশ্চিমবঙ্গ

আমরা হোলি খেলি না। দোলযাত্রায় মেতে উঠি। পালন করি বসন্তোৎসব। বসন্ত ঋতুকে স্বাগত জানিয়েই বাংলায় পালিত হয় এই রঙের পরব। রঙে রঙে রঙিন হয়ে ওঠে গোটা রাজ্য। কলকাতা হোক বা শান্তিনিকেতন, মায়াপুর হোক বা পুরুলিয়া সব স্থানেই শুধু রঙিন হাওয়া। দোলের দিন কেউ পুজো করেন রাধাকৃষ্ণকে, কেউ আবার নেচে ওঠেন রবি ঠাকুরের গানের তালে। কোথাও বের হয় কীর্তন সহকারে শোভাযাত্রা, কোথাও বের হয় প্রভাত ফেরি। তবে রঙের থেকে আবিরে রেহে উঠতে বাংলার মানুশ বেশি পছন্দ করেন। রং খেলার পাশাপাশি সারা বাংলা মেতে ওঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। বাঙালিদের কাছে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রতি বছরই হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলা বাইরের মানুষদের কাছে আমাদের দোলযাত্রা অত্যন্ত আকর্ষণীয়।