আগ্রায় নয়, তাজমহল তৈরি হওয়ার কথা ছিল এই শহরে, বিশ্বের সপ্তমাশ্চর্যকে ঘিরে রয়েছে নানা অদ্ভুত ঘটনা !

Spread the love


“পূর্ণিমার রাতে তাজমহলের সৌন্দর্য ভাষায প্রকাশ করা যায় না। এ যেন কালের কপোল তলে একবিন্দু নয়নের জল।”
তাজমহলের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে এমন উপমাই দিয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে সত্যি কথা বলতে কী, যতই বর্ণনা শুনুন না কেন তাজমহল প্রকৃতপক্ষে কতটা সুন্দর তা নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। বিশ্বের এই সপ্তমাশ্চর্যকে একবার চোখের দেখা দেখতে হাজার হাজার বিদেশি এদেশে আসেন। দেশিয়রাও তাজ দেখার লোভ সামলাতে পারেন না। দিনের বেলা হোক বা পূর্ণিমার রাত একেক সময় তাজের সৌন্দর্য একেক রকম। সেই সেকাল থেকে শুরু করে একাল তাজমহলের সামনে গিয়ে ছবি তোলার লোভ পর্যটকরা সামলাতে পারেন না। আগ্রার এই প্রাচীন স্মৃতিসৌধের নির্মাতা মুঘল সম্রাট শাহজাহান স্বয়ং। তাঁর নির্দেশেই প্রয়াত স্ত্রী মুমতাজের স্মৃতিতে এই সৌধ নির্মিত হয়। কেউ বলেন স্ত্রীর প্রতি সম্রাটের ভালোবাসার নিদর্শন এই মহল। কারও মতে অত্যাচারিত স্ত্রীর মৃত্যুর পর অনুশোচনার জেরে এই মহল নির্মাণ করেন সম্রাট। এসব নিয়ে নানা মুনির নানা মত। শ্বেত পাথরের তৈরি এই স্মৃতি সৌধের আনাচ কানাচে লুকিয়ে রয়েছে নানা তথ্য, নানা রহস্য, নানা অজানা ইতিহাসের কথা। (All photo credit: pexels.com)

​তাজমহলের ইতিহাস

একাধিক বেগমের বাদশাহ শাহজাহানের তৃতীয় স্ত্রী মুমতাজ বেগমের সঙ্গে সম্রাটের বিবাহিত জীবন ছিল ১৯ বছরের। অথচ মাত্র ১৯ বছরের বিবাহিত জীবনে মুমতাজ শাহজাহানের ১৪টি সন্তান প্রসব করেন। বলাবাহুল্য এই কারমেই তিনি ছিলেন শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল। শারীরিক ধকল সহ্য করতে না পেরে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে প্রাণ হারান মুমতাজ বেগম। এই তৃতীয় স্ত্রীর মৃত্যুর পরেই তাঁর স্মৃতিতে ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তাজমহল তৈরি শুরু করেছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান। তাঁর এই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করতে তাজ নির্মাণ যুক্ত ছিলেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। মহল তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০ বছর। তাজমহল বানানোর কাজ শেষ হয় ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে। যদিও এরপরে ছোটখাটো কাজ সম্পন্ন করতে আরও দুই বছর সময় লাগে। এটি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৩ কোটি ২০ লক্ষ টাকা।

​সৌধ জুড়ে আল্লাহ-র নাম

তাজমহলের দেওয়ালে যে সকল হস্তলিপির ব্যবহার করা হয়েছিল তা বেশিরভাগই মুসলিম ধর্ম গ্রন্থ কোরাণ শরিফ থেকে নেওয়া হয়েছিল। তাজমহলের দেওয়াল ছাড়াও মুমতাজ মহল এবং সম্রাট শাহজাহানের সমাধিতে এইরূপ শ্লোকগুলি খোদাই করা হয়েছিল। তাজমহলের বিভিন্ন স্থানে ক্যালিগ্রাফি শিলালিপি হিসেবে আল্লাহ-র ৯৯টি ভিন্ন নাম খোদাই করা রয়েছে।

​ইসলামিক, পার্সি এবং ভারতীয় সংস্কৃতির মিশ্রণ

তাজমহলের নকশা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এই তাজমহল বানানো হয়েছিল প্রধানত ভারতীয়, ফারসি এবং ইসলামিক ভাস্কর্যের সংমিশ্রণের দ্বারা। ফার্সি এবং ইসলামিক স্থাপত্যের মূলনীতি অনুসারে, তাজমহল প্রায় পুরোপুরি প্রতিসম। মিনার (টাওয়ার), দেওয়াল, কক্ষ এবং এমনকি বাগানগুলিও নিখুঁত প্রতিসাম্য অনুসরণ করে তৈরি। তাজমহল কুতুব মিনার থেকে ৫ ফিট বেশি উঁচু। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে, ঐতিহাসিকদের দাবি, যে সমস্ত কারিগররা তাজমহল তৈরি করেছিলেন তাঁদের হাত কেটে ফেলা হয়েছিল। ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের নির্মাণ আর না তৈরি হয় তাই এই ব্যবস্থা। তাজমহলের প্রধান কারিগরের নাম ওস্তাদ আহমেদ লাহরি।

​তাজমহলের দামি সাজ

তাজমহল নির্মাণ করার জন্য যেসকল সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছিল সেগুলি প্রধাণত ভারত এবং সমগ্র এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। এই সকল নির্মাণসামগ্রী পরিবহণের জন্য নাকি ১০০০-এরও বেশি হাতির ব্যবহার করা হয়েছিল। তাজমহল নির্মাণ করার জন্য যেসকল মার্বেল পাথরের প্রয়োজন হয়েছিল তা প্রধানত বিভিন্ন দেশ এবং ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে কেনা হয়েছিল। এর মধ্যে স্বচ্ছ সাদা মার্বেলটি রাজস্থানের মাকরানা নামক স্থান থেকে কেনা হয়েছিল। জেট এবং স্ফটিক কেনা হয়েছিল চিন থেকে। পঞ্জাব থেকে কেনা হয়েছিল জেম্পার। আফগানিস্তান থেকে ল্যাপিস লাজুলি। আরব থেকে কার্নেলিয়া। এবং তিব্বত থেকে কেনা হযেছিল ফিরোজা নামক মার্বেল পাথর।

​যুদ্ধের সময় লুকিয়ে ছিল তাজ

অনেকেই মনে করে যে, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় কিছুসংখ্যক ব্রিটিশ সৈন্য সমাধির দেওয়াল থেকে মূল্যবান পাথর গুলি নিয়ে নিয়েছিল। যাতে ধ্বংস করা না হয় তার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তরফে তাজমহলকে বাঁশের খাঁচা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। উপর থেকে একে দেখতে লাগছিল বাঁশের মজুদের মতো। একই রকম ভাবে তাজকে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময়।

​তাজের রং পরিবর্তন

তাজমহল দিনভর তার রং পরিবর্তন করতে থাকে। বিশ্বাস না হলেও কথাটা সত্যি। আসলে তাজমহল যেহেতু সাদা মার্বেল দিয়ে তৈরি তাই সূর্যের রশ্মি এর গায়ে পড়লে তার রং হলুদ হয়ে যায় এবং দিনের শেষে ধীরে ধীরে নীল হয়ে যায়। অনেকে এটিকে নিয়ে কাব্য করে থাকেন। তাঁদের বিশ্বাস যে, এই রং পরিবর্তনটি মুমতাজের মৃত্যুর আগে এবং পরে শাহজাহানের মানসিক পরিবর্তনকে বোঝায়।

​মুমতাজ মারা যান বুরহানপুরে

মুমতাজ বেগম মারা গিয়েছিলেন বর্তমান মধ্যপ্রদেশের বুরহানপুরে। অথচ তাঁর স্মৃতিসৌধটি রয়েছে উত্তর প্রদেশের আগ্রা শহরে। অবাক লাগলেও একথা সত্যি। প্রথমে অবশ্য আগ্রায় নয় সমাধি স্থল তৈরি হওয়ার কথা ছিল বুরহানপুরেই। তাপ্তি নদীর ধারে স্মৃতি সৌধ নির্মাণের কথা ভেবেছিলেন শাহজাহান। কিন্তু বুরহানপুর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য পর্যাপ্ত সাদা মার্বেল সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। এবং এই এই কারণেই আগ্রাতে শ্বেতপাথরের তাজমহল তৈরির কাজ শুরু হয়।



Source link